ট্রেডিং কাকে বলে?
ট্রেডিং বলতে আর্থিক বাজারে (যেমন: শেয়ার, বন্ড, কমোডিটি, কারেন্সি বা ডেরিভেটিভস) সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ের প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যার উদ্দেশ্য হলো মূল্যের ওঠানামা থেকে লাভ করা। এটি সাধারণত স্বল্পমেয়াদি হয় এবং বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রবণতা, খবর বা প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়।
অপশন এবং ফিউচার ট্রেডিং-এর পার্থক্য।
অপশন এবং ফিউচার উভয়ই ডেরিভেটিভ ট্রেডিং-এর অংশ, যেখানে একটি চুক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যতের মূল্যে সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় হয়। তবে তাদের মূল পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ:
বাধ্যবাধকতা: ফিউচার চুক্তিতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই নির্ধারিত তারিখে ও মূল্যে সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় করতে হয় (বাধ্যতামূলক)। অপশনে ক্রেতা শুধু অধিকার পায় (প্রিমিয়াম দিয়ে), কিন্তু বাধ্য নয়; বিক্রেতা বাধ্য হয় যদি ক্রেতা অধিকার প্রয়োগ করে।
সেটেলমেন্ট: ফিউচার দৈনিক সেটেল হয় (মার্ক-টু-মার্কেট), যাতে লাভ-লোকসান প্রতিদিন হিসাব হয়। অপশন সাধারণত মেয়াদ শেষে সেটেল হয়, এবং ক্রেতার সর্বোচ্চ লোকসান প্রিমিয়ামের পরিমাণ।
ঝুঁকি এবং খরচ: ফিউচারে ঝুঁকি বেশি কারণ বাধ্যতা রয়েছে এবং লিভারেজের কারণে লোকসান অসীম হতে পারে। অপশনে ঝুঁকি কম (ক্রেতার জন্য লিমিটেড), কিন্তু প্রিমিয়াম দিতে হয়। উভয়ই লিভারেজ ব্যবহার করে, কিন্তু অপশন আরও নমনীয়।
সারাংশে, ফিউচার হেজিং বা স্পেকুলেশনের জন্য উপযুক্ত যেখানে বাজার নিশ্চিত, আর অপশন ঝুঁকি সীমিত রেখে লাভের সুযোগ দেয়।
হেঁজিং সম্পর্কে জানুন:
হেজিং হলো একটি আর্থিক কৌশল যা বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে ব্যবহার করা হয়। এতে একটি সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষতি অফসেট করার জন্য একটি বিপরীত দিকের অবস্থান নেয়া হয়, যাতে বাজারের ওঠানামা থেকে লোকসান সীমিত রাখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার শেয়ারের দাম পড়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে ফিউচার বা অপশন চুক্তির মাধ্যমে বিপরীত অবস্থান নিয়ে হেজ করা যায়, যাতে লাভ-লোকসান ভারসাম্যপূর্ণ হয়। এটি সাধারণত ডেরিভেটিভস (যেমন: ফিউচার, অপশন) ব্যবহার করে করা হয় এবং লাভের পরিবর্তে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ফোকাস করে।
হেজিং-এর উদাহরণসমূহ
হেজিং হলো একটি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কৌশল যা বিনিয়োগ বা ব্যবসায়িক লোকসান কমাতে ব্যবহার করা হয়, যেখানে একটি সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষতি অফসেট করার জন্য বিপরীত অবস্থান নেয়া হয়। নীচে বিভিন্ন ধরনের হেজিং-এর বিস্তারিত উদাহরণ দেয়া হলো, যা আর্থিক বাজারে প্রয়োগ করা হয়। এগুলো ডেরিভেটিভস (যেমন: ফিউচার, অপশন, ফরওয়ার্ড কনট্রাক্ট) বা অন্যান্য কৌশলের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।
১. ডাইভার্সিফিকেশন (Diversification)
এটি একটি সাধারণ হেজিং কৌশল যেখানে বিনিয়োগকারী তার পোর্টফোলিওকে বিভিন্ন অসম্পর্কিত সম্পদে বিভক্ত করে, যাতে একটি সম্পদের পতন অন্যটির লাভ দিয়ে অফসেট হয়। উদাহরণ: একজন ব্যবসায়ী একটি হোটেলের শেয়ার, একটি প্রাইভেট হাসপাতালের শেয়ার এবং একটি মল চেইনের শেয়ার কেনেন। যদি পর্যটন শিল্পে কোনো নেতিবাচক ঘটনা ঘটে যা হোটেলের শেয়ারকে প্রভাবিত করে, তাহলে হাসপাতাল এবং মলের শেয়ারগুলো অপ্রভাবিত থাকবে কারণ এগুলো সম্পর্কহীন। এতে সামগ্রিক ঝুঁকি কমে।
এই কৌশল ক্রিপ্টো ট্রেডিং-এও প্রয়োগ করা যায়, যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো প্রায়শই বিটকয়েনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে, যা ডাইভার্সিফিকেশনকে চ্যালেঞ্জিং করে।
২. অ্যারবিট্রেজ (Arbitrage)
এটি একটি কম-ঝুঁকির হেজিং কৌশল যেখানে একটি সম্পদকে এক বাজারে কম দামে কিনে অন্য বাজারে বেশি দামে বিক্রি করা হয়, যাতে ছোট কিন্তু নিশ্চিত লাভ হয়। উদাহরণ: একজন জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্র তার বাড়ির কাছে একটি আউটলেট স্টোর থেকে অ্যাসিক্স জুতোর একটি জোড়া ৪৫ ডলারে কেনে এবং তার স্কুলমেটকে ৭০ ডলারে বিক্রি করে, যিনি ডিপার্টমেন্ট স্টোরে ১১০ ডলারের চেয়ে সস্তায় পান। এখানে দামের পার্থক্য থেকে লাভ হেজিং-এর মতো কাজ করে, যা বাজারের অদক্ষতা থেকে সুরক্ষা দেয়। এটি স্টক মার্কেটে সাধারণ।
৩. অ্যাভারেজ ডাউন (Average Down)
এই কৌশলটিতে সম্পদের দাম পড়ার পর অতিরিক্ত ইউনিট কেনা হয়, যাতে গড় ক্রয়মূল্য কমে যায় এবং লোকসান অফসেট হয়। উদাহরণ: একজন বিনিয়োগকারী উচ্চ দামে শেয়ার কেনেন, কিন্তু দাম উল্লেখযোগ্যভাবে পড়ে যায়। তিনি নিম্ন দামে আরও শেয়ার কেনেন। যদি দাম দুটি ক্রয়মূল্যের মাঝামাঝি স্তরে উঠে, তাহলে দ্বিতীয় ক্রয়ের লাভ প্রথমটির লোকসান অফসেট করে। এটি স্টক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়।
৪. স্টেয়িং ইন ক্যাশ (Staying in Cash)
এটি একটি সরল কৌশল যেখানে পোর্টফোলিওর একটি অংশ নগদে রাখা হয়, যাতে বাজারের পতনে সম্পদ বিক্রি করতে না হয় বা নিম্ন দামে কেনা যায়। উদাহরণ: একজন বিনিয়োগকারী তার তহবিলের একটি অংশ নগদে রাখেন, যাতে বাজারের অস্থিরতায় লোকসান এড়ানো যায় এবং সুযোগমতো সম্পদ কেনা যায়। এটি অন্যান্য বিনিয়োগের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দেয়।
৫. ফিউচার কনট্রাক্টের মাধ্যমে কমোডিটি হেজিং (e.g., এয়ারলাইন ফুয়েল হেজিং)
এটি কমোডিটি-নির্ভর কোম্পানিগুলোর জন্য উপযুক্ত। উদাহরণ: একটি এয়ারলাইন কোম্পানি, যার লাভ ফুয়েলের দামের উপর নির্ভর করে, ফুয়েলের দাম বাড়ার আশঙ্কায় ফিউচার কনট্রাক্ট করে। এতে ভবিষ্যতে একটি নির্দিষ্ট দামে ফুয়েল কেনার চুক্তি হয়। যদি ফুয়েলের দাম বাড়ে, তাহলে কনট্রাক্ট থেকে লাভ লোকসান অফসেট করে; কিন্তু দাম কমলে, কনট্রাক্টের দামে কিনতে হয়, যা লাভ কমাতে পারে।
৬. পুট অপশনের মাধ্যমে স্টক হেজিং
এটি স্টকের দাম পড়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। উদাহরণ: একজন বিনিয়োগকারী ১০০টি শেয়ার ২০ ডলারে কেনেন এবং দাম পড়ার আশঙ্কায় ১৭ ডলার স্ট্রাইক প্রাইসের সাথে ১৮ মাসের পুট অপশন কেনেন। এতে তিনি যেকোনো সময় ১৭ ডলারে শেয়ার বিক্রি করতে পারেন, যদিও বাজার দাম কম হয়। এটি লোকসান সীমিত করে।
৭. বিয়ার পুট স্প্রেড (Bear Put Spread)
এটি ইনডেক্স বিনিয়োগকারীদের জন্য। উদাহরণ: বিনিয়োগকারী উচ্চ স্ট্রাইক প্রাইসের পুট কেনেন এবং নিম্ন স্ট্রাইক প্রাইসের পুট বিক্রি করেন, একই মেয়াদে। দুটি স্ট্রাইক প্রাইসের পার্থক্য অপ্রত্যাশিত ইনডেক্স আচরণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।
৮. ফরওয়ার্ড কনট্রাক্টের মাধ্যমে কারেন্সি হেজিং
এটি বৈদেশিক ব্যবসায়ের জন্য। উদাহরণ: একটি কোম্পানি ৬ মাস পর একটি ইনভয়েস পরিশোধ করবে। তারা ফরওয়ার্ড কনট্রাক্ট করে বর্তমান রেটে কারেন্সি লক করে, যাতে এক্সচেঞ্জ রেটের ওঠানামা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। আরও জটিল কৌশলে একাধিক কনট্রাক্ট স্ট্যাগার্ড ম্যাচুরিটি সাথে ব্যবহার করা হয়, যেমন: মাসিক ১০০,০০০ ডলারের জন্য ৬টি কনট্রাক্ট, যা রোলিং হেজ তৈরি করে।
৯. লেয়ার্ড ফরওয়ার্ড কনট্রাক্ট (Layered Forward Contracts)
এটি বড় কোম্পানিগুলোর জন্য। উদাহরণ: একটি কানাডিয়ান এক্সপোর্টার ইউএসডি-তে পেমেন্ট পায় কিন্তু সিএডি-তে অপারেট করে। তারা ১২ মাসের জন্য বিভিন্ন অ্যামাউন্টের কনট্রাক্ট করে: ১-৩ মাসে ৮০% কভারেজ, ৪-৬ মাসে ৬০%, ইত্যাদি। এটি গড় রেট স্মুথ করে এবং ঝুঁকি কমায়।
১০. সাধারণ জীবনের উদাহরণ: কার ইনস্যুরেন্স
যদিও আর্থিক নয়, এটি হেজিং-এর সহজ উদাহরণ। উদাহরণ: গাড়ির ইনস্যুরেন্স দুর্ঘটনা বা চুরির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, যেখানে পলিসি মেরামতের খরচের অংশ বহন করে। এটি আর্থিক লোকসান অফসেট করে।
এই উদাহরণগুলো দেখায় যে হেজিং লাভের পরিবর্তে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ফোকাস করে, কিন্তু এতে খরচ (যেমন: প্রিমিয়াম) জড়িত থাকতে পারে এবং সবসময় লাভজনক নাও হতে পারে যদি বাজার অনুকূলে যায়। বিনিয়োগের আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
Post a Comment